বাংলাদেশে তিনটি দোয়া কুনুত: উচ্চারণ, অর্থ ও ফজিলত জানুন

বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে বিতর নামাজের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এই নামাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো “তিনটি দোয়া কুনুত”। নামাজের এই বিশেষ দোয়াগুলোর ফজিলত, উচ্চারণ ও অর্থ জানলে আমাদের ইবাদত আরও সুন্দর ও অর্থবহ হয়। আজকের এই ব্লগে আমরা জানবো তিনটি দোয়া কুনুত কী, কখন ও কিভাবে পড়তে হয়, এবং এগুলোর অর্থ ও গুরুত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা।

আর্টিকেল সূচিপত্রঃ নিচের যে অংশে পড়তে চান তার উপর ক্লিক করুন

তিনটি দোয়া কুনুত: ইসলামের আলোকে

কুনুত শব্দটি আরবি ‘কানাত’ থেকে এসেছে, যার অর্থ নীরবতা, বিনয়, ইবাদত ও আল্লাহর সামনে দাঁড়ানো। ইসলামে কুনুত বলতে বোঝায়-নামাজে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে বিশেষভাবে দোয়া করা। বিশেষত বিতর নামাজের তৃতীয় রাকাতে “তিনটি দোয়া কুনুত” পড়ার বিধান রয়েছে, যা রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহর অংশ।

বিতর নামাজে তিনটি দোয়া কুনুত

বিতর নামাজে তিনটি দোয়া কুনুত মূলত তিনটি দোয়ার সংমিশ্রণ। এগুলো হলো-

  • বিতরের মূল দোয়া কুনুত (সর্বাধিক প্রচলিত)
  • দোয়া কুনুত নাযিলা (বিশেষ বিপদের সময়)
  • তাহাজ্জুদে পড়া বিশেষ দোয়া কুনুত

এগুলো পড়ার মাধ্যমে মুসল্লি আল্লাহর কাছে সাহায্য, ক্ষমা, রহমত ও বিপদ থেকে মুক্তি চেয়ে প্রার্থনা করে।

বাংলাদেশে তিনটি দোয়া কুনুত: উচ্চারণ, অর্থ ও ফজিলত জানুন

তিনটি দোয়া কুনুত: উচ্চারণ ও অর্থ

বিতর নামাজের দোয়া কুনুত

আরবি উচ্চারণ:

اللَّهُمَّ إِنَّا نَسْتَعِينُكَ وَنَسْتَغْفِرُكَ وَنُؤْمِنُ بِكَ وَنَتَوَكَّلُ عَلَيْكَ وَنُثْنِي عَلَيْكَ الْخَيْرَ كُلَّهُ نَشْكُرُكَ وَلَا نَكْفُرُكَ وَنَخْلَعُ وَنَتْرُكُ مَنْ يَفْجُرُكَ، اللَّهُمَّ إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَلَكَ نُصَلِّي وَنَسْجُدُ وَإِلَيْكَ نَسْعَى وَنَحْفِدُ نَرْجُو رَحْمَتَكَ وَنَخْشَى عَذَابَكَ إِنَّ عَذَابَكَ بِالْكُفَّارِ مُلْحَقٌ

বাংলা উচ্চারণ:
আল্লাহুম্মা ইন্না নাসতায়িনুকা ওয়া নাসতাগফিরুকা, ওয়ানুমিনু বিকা ওয়া নাতাওয়াক্কালু আলাইকা ওয়া নুছনি আলাইকাল খাইর। ওয়া নাসকুরুকা ওয়ালা নাকফুরুকা, ওয়ানাখলাউ ওয়ানাতরুকু মাইয়্যাফজুরুকা। আল্লাহুম্মা ইয়্যাকানা’বুদু ওয়ালাকা নুছল্লি, ওয়ানাসজুদু ওয়া ইলাইকা নাসআ; ওয়া নাহফিদু ওয়া নারজু রাহমাতাকা, ওয়া নাখশা আজাবাকা; ইন্না আজাবাকা বিলকুফফারি মুলহিক।

অর্থ:
হে আল্লাহ! আমরা তোমারই সাহায্য চাই, তোমারই কাছে ক্ষমা চাই, তোমারই প্রতি ঈমান রাখি, তোমারই ওপর ভরসা করি এবং সব মঙ্গল তোমারই দিকে ন্যস্ত করি। আমরা তোমার কৃতজ্ঞ হয়ে চলি, অকৃতজ্ঞ হই না। হে আল্লাহ! আমরা তোমারই দাসত্ব করি, তোমারই জন্য নামাজ পড়ি এবং তোমাকেই সিজদা করি। আমরা তোমারই দিকে দৌড়াই ও এগিয়ে চলি। আমরা তোমারই রহমত আশা করি এবং তোমার আজাবকে ভয় করি। আর তোমার আজাব তো কাফেরদের জন্যই নির্ধারিত।

দোয়া কুনুত নাযিলা (বিশেষ বিপদের সময়)

বিশেষ কোনো জাতীয়, সামাজিক বা ব্যক্তিগত বিপদে পড়লে এই দোয়া পড়া হয়। নবী (সা.) যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ বা মুসলিমদের ওপর অত্যাচার হলে এই দোয়া পড়তেন। এ দোয়ায় আল্লাহর কাছে রক্ষা, সাহায্য ও বিপদ থেকে মুক্তি চাওয়া হয়।

উদাহরণ:
যখন কোনো মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার হয়, তখন ইমাম জামাতে এই দোয়া কুনুত নাযিলা পড়তে পারেন।

তাহাজ্জুদে দোয়া কুনুত

রাতের তাহাজ্জুদ নামাজে ইচ্ছা করলে বিশেষভাবে দোয়া কুনুত পড়া যায়। এতে আল্লাহর কাছে একান্তভাবে অনুগ্রহ ও রহমত চাওয়া হয়।

তিনটি দোয়া কুনুত পড়ার নিয়ম

  • বিতর নামাজের তৃতীয় রাকাতে সুরা ফাতিহা ও অন্য কোনো সুরা পড়ার পর অতিরিক্ত তাকবির দিয়ে দু’হাত কান পর্যন্ত উঠিয়ে আবার হাত বাঁধতে হয়।
  • এরপর চুপিসারে তিনটি দোয়া কুনুত পড়া হয়।
  • দোয়া শেষ হলে যথারীতি রুকু, সিজদা ও তাশাহুদ পড়ে নামাজ শেষ করতে হয়।
  • বিশেষ বিপদের সময় ইমাম জামাতে উচ্চস্বরে দোয়া কুনুত নাযিলা পড়তে পারেন।

তিনটি দোয়া কুনুতের ফজিলত ও গুরুত্ব

  • এই দোয়াগুলো আল্লাহর কাছে বান্দার বিনয়, কৃতজ্ঞতা ও সাহায্য চাওয়ার একান্ত মাধ্যম।
  • রাসুল (সা.) নিজে বিতর ও বিশেষ বিপদের সময় এই দোয়া পড়তেন এবং সাহাবিদেরও পড়তে উৎসাহিত করতেন।
  • তিনটি দোয়া কুনুত পড়ার ফলে আল্লাহ বান্দার দোয়া কবুল করেন, বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করেন, রহমত ও বরকত দান করেন।

উদাহরণ:
একজন মুসল্লি প্রতিদিন বিতর নামাজে এই দোয়া পড়ে আল্লাহর কাছে নিজের ও পরিবারের জন্য কল্যাণ, বিপদ থেকে মুক্তি এবং ঈমানের দৃঢ়তা প্রার্থনা করতে পারেন।

তিনটি দোয়া কুনুত: বাস্তব জীবনে প্রভাব

তিনটি দোয়া কুনুত শুধু নামাজের অংশ নয়, বরং মুসলমানদের জীবনের প্রতিটি সংকটে, দুঃসময়ে ও বিপদের সময় আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার এক অনন্য উপায়। এই দোয়াগুলো আমাদের আত্মবিশ্বাস ও আস্থা দৃঢ় করে, কারণ আমরা জানি-সব সমস্যার সমাধান একমাত্র আল্লাহর কাছেই।

কেন তিনটি দোয়া কুনুত মুখস্থ ও চর্চা করবেন?

  • ইবাদতে মনোযোগ বাড়ে এবং নামাজে একাগ্রতা আসে।
  • বিপদের সময় দ্রুত আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে পারেন।
  • পরিবার ও সন্তানদের শেখাতে পারবেন, ফলে তারা ছোটবেলা থেকেই দোয়া ও ইবাদতের গুরুত্ব উপলব্ধি করবে।

সংক্ষেপে তিনটি দোয়া কুনুতের মূল শিক্ষা

বাংলাদেশে তিনটি দোয়া কুনুত: উচ্চারণ, অর্থ ও ফজিলত জানুন

  • আল্লাহর কাছে বিনয় ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
  • বিপদে-আপদে তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়া
  • ঈমান ও আমলের দৃঢ়তা কামনা
  • আল্লাহর রহমত ও শাস্তি সম্পর্কে সচেতনতা

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নোত্তর 

ছোট দোয়া কুনুত কী?

ছোট দোয়া কুনুত বলতে সাধারণত বিতর নামাজে পড়া সংক্ষিপ্ত কুনুতের দোয়াকে বোঝানো হয়। এটি সহজে মুখস্থ করার জন্য সংক্ষিপ্তভাবে পড়া হয়, যাতে ছোটরাও সহজে শিখতে পারে। অনেকেই “আল্লাহুম্মাগফিরলি…” দিয়ে শুরু হওয়া সংক্ষিপ্ত দোয়াটিকে ছোট দোয়া কুনুত হিসেবে পড়ে থাকেন।

দোয়া কুনুতের বাংলা উচ্চারণ কী?

দোয়া কুনুতের বাংলা উচ্চারণ হলো:
আল্লাহুম্মা ইন্না নাসতায়িনুকা ওয়া নাসতাগফিরুকা, ওয়ানুমিনু বিকা ওয়া নাতাওয়াক্কালু আলাইকা ওয়া নুছনি আলাইকাল খাইর, ওয়া নাসকুরুকা ওয়ালা নাকফুরুকা, ওয়ানাখলাউ ওয়ানাতরুকু মাইয়্যাফজুরুকা, আল্লাহুম্মা ইয়্যাকানা’বুদু ওয়ালাকা নুছল্লি ওয়ানাসজুদু ওয়া ইলাইকা নাসআ ওয়া নাহফিদু, নারজু রাহমাতাকা ওয়া নাখশা আজাবাকা, ইন্না আজাবাকা বিলকুফফারি মুলহিক।

আল্লাহুম্মা ইন্না নাস্তাইনুকা আলা ত্ব’আতিক এর অর্থ কী?

এর অর্থ হলো: “হে আল্লাহ! আমরা তোমারই সাহায্য চাই তোমার আদেশ পালন করার জন্য।” অর্থাৎ, ইবাদত ও ভালো কাজ করতে আল্লাহর সাহায্য চাওয়া হচ্ছে।

কুনুতের দুআ কি?

কুনুতের দুআ হলো বিতর নামাজের তৃতীয় রাকাতে বিশেষভাবে পড়া একটি দোয়া, যাতে আল্লাহর কাছে সাহায্য, ক্ষমা ও রহমত চাওয়া হয়। এটি রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহ এবং মুসলিমদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আমল।

তিনটি দোয়া কুনুত কখন পড়া হয়?

তিনটি দোয়া কুনুত সাধারণত বিতর নামাজের শেষ রাকাতে পড়া হয়। এছাড়া বিশেষ বিপদের সময় বা তাহাজ্জুদ নামাজেও পড়া যেতে পারে।

তিনটি দোয়া কুনুত মুখস্থ করা কেন জরুরি?

মুখস্থ করলে নামাজে মনোযোগ বাড়ে, ইবাদত সুন্দর হয় এবং যেকোনো সময় বিপদের মুহূর্তে সহজেই আল্লাহর কাছে দোয়া করা যায়।

দোয়া কুনুত কি শুধু বিতর নামাজেই পড়তে হয়?

প্রধানত বিতর নামাজে পড়া হয়, তবে বিশেষ বিপদের সময় বা জামাতে ইমাম কুনুত নাযিলা পড়তে পারেন। তাহাজ্জুদ নামাজেও পড়া যেতে পারে।

তিনটি দোয়া কুনুত পড়ার নিয়ম কী?

বিতর নামাজের তৃতীয় রাকাতে সুরা পড়ার পর অতিরিক্ত তাকবির দিয়ে হাত তুলতে হয়, এরপর দোয়া কুনুত পড়ে নামাজ শেষ করতে হয়।

তিনটি দোয়া কুনুতের ফজিলত কী?

এই দোয়াগুলো পড়লে আল্লাহর রহমত, সাহায্য ও ক্ষমা পাওয়া যায়। বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যও এই দোয়া খুবই ফজিলতপূর্ণ।

তিনটি দোয়া কুনুত কোথায় পাওয়া যাবে?

বিভিন্ন ইসলামিক বই, নামাজ শিক্ষা বই, অনলাইন ইসলামিক ওয়েবসাইট এবং ইউটিউব চ্যানেলে তিনটি দোয়া কুনুতের আরবি, বাংলা উচ্চারণ ও অর্থ পাওয়া যায়।

শেষ কথা

“তিনটি দোয়া কুনুত” মুসলিম জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রতিদিনের বিতর নামাজে, বিশেষ বিপদের সময় কিংবা রাতের তাহাজ্জুদে এই দোয়াগুলো পড়ে আমরা আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে পারি। এই দোয়াগুলো মুখস্থ করুন, পরিবারের সবাইকে শেখান এবং নিয়মিত চর্চা করুন-তাহলেই আপনার ইবাদত হবে আরও সুন্দর, হৃদয়গ্রাহী ও অর্থবহ।

আপনি কি তিনটি দোয়া কুনুত মুখস্থ করেছেন?

আজই শুরু করুন এই দোয়াগুলো পড়া ও চর্চা। আপনার বন্ধু ও পরিবারের সঙ্গে শেয়ার করুন, যেন সবাই এই বরকতময় আমল থেকে উপকৃত হতে পারে!

আল্লাহ আমাদের সবাইকে তিনটি দোয়া কুনুত পড়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × 3 =